নিজস্ব প্রতিবেদক ::
খুলনা থেকে কিভাবে কম সময়ের মধ্যে চট্টগ্রাম যাওয়া যায় তা নিয়ে গবেষণা করছে আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক উপকমিটির ‘সড়ক যোগাযোগ টাস্কফোর্স’। সেই গবেষণায় বের হয়ে এসেছে দেশে আরেকটি ‘দ্রুতগতির প্রশস্ত এক্সপ্রেসওয়ে’। সম্ভাব্য এক্সপ্রেসওয়েটি হবে খুলনার মোংলা-বরগুনা-পটুয়াখালী-ভোলা-হাতিয়া-সন্দ্বীপ-চট্টগ্রাম। এটিই দেশের সর্ব দক্ষিণে পূর্ব ও পশ্চিমের একমাত্র সংযোগ সড়ক হবে।
চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা হয়ে খুলনা যেতে যেখানে প্রায় ২০ ঘণ্টা লাগে সেখানে এই এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে যেতে সময় লাগবে মাত্র সাড়ে ৪ ঘণ্টা। প্রায় সাড়ে ৩শ কিলোমিটার সড়কটির মধ্যে ৬৯ কিলোমিটার হবে সেতু। এই সড়কটি নির্মাণে ব্যয় হতে পারে প্রায় সোয়া এক লাখ কোটি টাকা। তবে ব্যয়ের তুলনায় আয়ের দরজাও খুলবে এই মহাসড়কটি। সমুদ্রের উপকূলীয় অঞ্চলে তৈরি করা হলে যেমন বিভিন্ন বন্দর ব্যবহার করা যাবে, ঠিক তেমনি দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনৈতিক চাকাও ঘুরবে বলে মনে করছেন প্রকৌশলীরা।
গবেষণা সূত্রে জানা যায়, খুলনা বিভাগকে চট্টগ্রাম বিভাগের সঙ্গে সড়কপথে সংযুক্ত করতে আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক উপকমিটি ‘সড়ক যোগাযোগ টাস্কফোর্স’ নামে একটি কমিটি গঠন করে। সেই কমিটি গত ৬ জানুয়ারি থেকে কাজ শুরু করেছে। তারা দেশের পূর্ব-পশ্চিমকে সড়ক পথে এক করতে সম্ভাব্য পাঁচটি রুট তৈরি করেছেন।
সম্ভাব্য রুট-১: খুলনা-শরীয়তপুর-চাঁদপুর-ফেনী ও চট্টগ্রাম। সেখানে সড়কের মোট দৈর্ঘ্য ৩৫১ কিমি, পুনর্বাসিত দৈর্ঘ্য ৩৪৬ কিমি। ভ্রমণের সময় ধরা হয়েছে ৪ ঘণ্টা ৩০ মিনিট। এই দৈর্ঘ্যের মধ্যে সেতু হবে ৪.৯ কিমি।
সম্ভাব্য রুট-২: খুলনা-বরিশাল-ভোলা-লক্ষ্মীপুর-নোয়াখালী-ফেনী ও চট্টগ্রাম। সেখানে সড়কের মোট দৈর্ঘ্য ৩৩৪ কিমি, পুনর্বাসিত দৈর্ঘ্য ৩১৩ কিমি। ভ্রমণের সময় ধরা হয়েছে ৪ ঘণ্টা ১০ মিনিট। এই দৈর্ঘ্যের মধ্যে সেতু হবে- ১৬.৬ কিমি।
সম্ভাব্য রুট-৩ ক: খুলনা-পটুয়াখালী-ভোলা-হাতিয়া-সন্দ্বীপ ও চট্টগ্রাম। সেখানে সড়কের মোট দৈর্ঘ্য ৩৩৯ কিমি, পুনর্বাসিত দৈর্ঘ্য ২৬৯ কিমি। ভ্রমণের সময় ধরা হয়েছে ৪ ঘণ্টা ১৫ মিনিট। এই দৈর্ঘ্যের মধ্যে সেতু হবে ৬৩.৭ কিমি।
সম্ভাব্য রুট-৩ খ: খুলনা-পটুয়াখালী-ভোলা-হাতিয়া-সন্দ্বীপ ও চট্টগ্রাম। সেখানে সড়কের মোট দৈর্ঘ্য ৩০৬ কিমি, পুনর্বাসিত দৈর্ঘ্য ২৪৪ কিমি। ভ্রমণের সময় ধরা হয়েছে ৪ ঘণ্টা। এই দৈর্ঘ্যের মধ্যে সেতু হবে ৬০.৯ কিমি।
সম্ভাব্য রুট-৩ গ: মোংলা-বরগুনা-পটুয়াখালী-ভোলা-হাতিয়া-সন্দ্বীপ-চট্টগ্রাম। সেখানে সড়কের মোট দৈর্ঘ্য ৩৪৮ কিমি, পুনর্বাসিত দৈর্ঘ্য ২৭২ কিমি। ভ্রমণের সময় ধরা হয়েছে ৪ ঘণ্টা ২০ মিনিট। এই দৈর্ঘ্যের মধ্যে সেতু হবে ৬৯.৯ কিমি।
সম্ভাব্য রুট-১ এর পাশাপাশি সহযোগী হিসাবে ৩ গ-কে এক্সপ্রেসওয়ের জন্য প্রাথমিকভাবে মনে করছেন প্রকৌশলীরা। সম্ভাব্য রুট ৩ গ-এর জন্য ব্যয় হতে পারে সোয়া ১ লাখ কোটি টাকা।
এই উপকমিটির সদস্যরা দীর্ঘ ছয় মাস কাজ করেছেন। সরকারের পক্ষ থেকে ওবায়দুল কাদেরের কাছে বিষয়টি বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এ নিয়ে হয়েছে সভা ও সেমিনার। উপকূলীয় অঞ্চল দিয়ে এই এক্সপ্রেসওয়ে হলেও নদী-খালগুলোর কোনো সমস্যা হবে না। সব ঠিক রেখেই এটা করা সম্ভব। পরিবেশের কোনো ক্ষতি হবে সেই চিন্তা মাথায় রেখেই এই গবেষণা করা হচ্ছে। এই সড়কের মধ্যে এমন কিছু সেতু নির্মাণ করা হবে যা দেখতে পর্যটকরাও দেখতে আসবে জানান উপকমিটির সদস্যরা।
এই টাস্কফোর্সের আহ্বায়ক হিসেবে রয়েছেন বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. ইঞ্জিনিয়ার এ এফ এম সাইফুল আমিন। তার সঙ্গে সহযোগিতা করেছেন প্রকৌশলী মনির হোসেন পাঠান, প্রকৌশলী অতিম কুমার চক্রবর্তী, প্রকৌশলী মো. আমির হোসেন, প্রকৌশলী কাজী মো, ফেরদৌস।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক ইঞ্জি. মো. আবদুস সবুর বলেন, খুলনা থেকে চট্টগ্রাম সাড়ে ৪ ঘণ্টার মধ্যে যেতে পারি এর জন্য গত ৬ মাস কাজ করেছেন উপ-কমিটির টাস্কফোর্সের সদস্যরা। এ ধরনের পূর্ব-পশ্চিম সংযোগ হয়েছে এমন কোনো সড়ক বর্তমানে নেই, নতুন করে করতে হবে। এটা হলে বেশ কয়েকটি সমুদ্র বন্দর কানেক্টেট হবে এবং ব্যবসার সুযোগ বেড়ে যাবে।
কেন এই সড়ক শনাক্ত করা হলো এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘পৃথিবীর সব দেশেই সমুদ্রকে কেন্দ্র করে যত উন্নয়ন হয়। সেদিকে আমরা দেখেছি, আমাদের সমুদ্রের পাশের লোকজন অবহেলিত। এই সড়কটি হলে খুলনা বিভাগ, বরিশাল বিভাগ ও চট্টগ্রাম বিভাগ লাভবান হবেন। এটা হলে, পর্যটনক্ষেত্রে বিশাল ভূমিকা রাখবে, সমুদ্রের উপকূলীয় এলাকার মানুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে, মোংলা সমুদ্র বন্দর, পায়রা সমুদ্র বন্দর, চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর এক সড়কেই পড়বে। মানুষের যাতায়াত খরচ কমবে। তিনি বলেন, সমুদ্র থেকে যে আমাদের বিশাল অর্থের সম্ভাবনা রয়েছে যা ব্লু ইকোনমিতে জাতীয় ভূমিকা রাখবে। এই সড়কের ফলে ভারত, নেপালসহ বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে বিজনেস হাব তৈরি হবে। নতুন নতুন নগরায়ণ সৃষ্টি হবে।’
আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক বলেন, ‘আগে আমরা মনে করতাম টোল হলো প্রধান আয়। এখানে টোল ছাড়াও ইন-ডাইরেক বেনিফিট অনেক। যে ব্যয় হবে তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি অন্যান্য আয় হবে। জিডিপি হার ২ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া সড়কটিকে ঘিরে নতুন নতুন ইকোনমিক জোন তৈরি হবে। সেই গবেষণা করতে গিয়ে বাংলাদেশ ব্রিজ অর্থনীতি, সড়ক ও জনপথ অর্থনীতির সহযোগিতা নেয়া হয়েছে। বুয়েটের অভিজ্ঞ শিক্ষকরাও সহযোগিতা করেছেন।’
প্রকৌশলী দলকে নেতৃত্ব দানকারী অধ্যাপক ড. ইঞ্জিনিয়ার এ এফ এম সাইফুল আমিন বলেন, আগামীর উন্নয়ন মহাপরিকল্পনায় এই মহাসড়কগুলোর অনতিবিলম্বে প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করা প্রয়োজন। ভবিষ্যতের যোগাযোগ প্রয়োজনীয়তাটাকে আমাদের সবসময় সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। আমাদের সম্ভাব্য অর্জন হতে পারে আমাদের ব্লু-ইকোনমি, গভীর সমুদ্র বন্দর, পর্যটন খাত, সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন, সমুদ্র তীর রক্ষা, জেগে ওঠা ভূমি রক্ষা, কর্মসংস্থান, নদী তীরের সংরক্ষণ এবং লবণাক্ততা দূরীকরণ। নতুন রুট নির্বাচনের আমাদের ব্যয় যুক্তিযুক্ত রাখার জন্য বর্তমান সড়ক পথগুলোকে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। নদী এবং নৌ রুটকে আমাদের সংরক্ষণ বিবেচনায় নেয়া হয়েছে।
গত ১ অক্টোবর ‘বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা শেখ হাসিনার উন্নয়নের সংগ্রাম, নিরবচ্ছিন্ন স্বপ্নের মহাসড়কে খুলনা থেকে চট্টগ্রাম’ সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সেই সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. ইঞ্জিনিয়ার এ এফ এম সাইফুল আমিন। আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক উপ-কমিটির চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মো. হোসেন মনসুর, সেমিনার পরিচালনা করেন উপ-কমিটির সদস্য সচিব ইঞ্জিনিয়ার মো. আবদুস সবুর। সেই উপস্থাপনার উপরে ৪ জন প্রকৌশলী বক্তব্য রাখেন। তারা হলেন— সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী এ কে এম মনির হোসেন পাঠান, বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী কাজী মো. ফেরদৌস, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরপ্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক প্রফেসর ড. মিজানুর রহমান, আইইভি’র প্রেসিডেন্ট প্রকৌশলী মো. নুরুল হুদা প্রমুখ।
সেমিনারে প্রকৌশলী কাজী মোহাম্মদ ফেরদৌস বলেন, আমরা আমাদের প্রস্তুতি মাননীয় মন্ত্রীর নেতৃত্বে অলরেডি নিয়ে ফেলেছি। আমরা সেতু কর্তৃপক্ষের হয়ে একটা মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করছি। সেতু কর্তৃপক্ষ এই এলাকায় কী ধরনের কাজ করতে পারে সেজন্য আগামী ৪১ সাল পর্যন্ত ২০ বছরের জন্য একটা মহাপরিকল্পনা যেখানে সরকারের রূপকল্প ২০৪১-কে লক্ষ্য করে পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এই মাস্টারপ্ল্যানের আওতায় শরীয়তপুর-চাঁদপুর করিডরে আমরা একটা সেতুর সম্ভাবনা সমীক্ষা শুরু করেছি। অলরেডি স্পেনের টিপ্সা নামক একটি প্রতিষ্ঠান এবং জাপানের একটি প্রতিষ্ঠান এই কাজ শুরু করেছে আমরা এটা নিবিড় তত্ত্বাবধান করছি। তারা ইন্সপেকশন রিপোর্ট দাখিল করেছে। আমাদের এটা বিস্তারিত আলোচনার পর মাননীয় মন্ত্রী সময় দিলে সেখানে এটা উপস্থাপন করা হবে। তার পরবর্তিতে এটা আমরা এই কমিটির কাছেও ইন্সপেকশন রিপোর্ট দেব এবং তারা যেন এই সড়কের মহাপরিকল্পনায় আমাদের মাস্টারপ্ল্যানের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে।
সেমিনারে প্রফেসর ড. প্রকৌশলী মো. মিজানুর রহমান বলেন, আমাদের বর্তমানে যে মহাসড়কগুলো রয়েছে সেগুলোয় গড় গতি কিন্তু খুব বেশি নয়। ২০৪১-এ পৌঁছাতে হলে এই গতি আমাদের অবশ্যই ঘণ্টায় ৮০-১০০ কিলোমিটারে নিয়ে যেতে হবে। নিকট ভবিষ্যতে বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে এটি ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারবে এবং মহীসোপানকে কেন্দ্র করে প্রধানমন্ত্রী যে ব্লু-ইকোনমি কনসেপ্ট দিয়েছেন তার সঙ্গে এই প্রোপোজালের বা প্রোপোজ রুটের একটি সমন্বয় ঘটাতে হবে এবং মহীসোপান ঘেঁষে যে নৌপথ আছে তার সঙ্গে কীভাবে সমন্বয় করা যায় সে বিষয়েও কিন্তু আমাদের আগাম পরিকল্পনা করা প্রয়োজন। কারণ একটি দেশের টেকসই যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য প্রয়োজন সড়কপথ, নৌপথ, রেলপথ এবং আকাশ পথের মধ্যে যথাযথ সমন্বয় সাধন করা।
প্রকৌশলী মো. নুরুল হুদা বলেন, এখন রোডস অ্যান্ড হাইওয়ে ডিপার্টমেন্টের জন্য ড. সাইফুল আমিন যেটি উপস্থাপন করেছেন- এর জন্য একটা মাস্টারপ্ল্যান প্রয়োজন। এই মাস্টারপ্ল্যান আর সেতু কর্তৃপক্ষের মাস্টারপ্ল্যান— এ দুটির যোগসূত্র এবং তা কম্পাইল করে আমাদের এই রুটগুলো যদি আমরা চূড়ান্ত করি তাহলে আমাদের বৃহত্তর খুলনা, বৃহত্তর বরিশাল, বৃহত্তর নোয়াখালী ও বৃহত্তর চট্টগ্রাম সুবিধা পাবে। ঠিক যেভাবে পদ্মা সেতুর জন্য সুবিধা পাবে বৃহত্তর ফরিদপুর, বৃহত্তর বরিশাল ও বৃহত্তর খুলনা। মানবকন্ঠ
পাঠকের মতামত: